আমাদের প্রকাশনাশিল্পে জৌলুশ এসেছে। আর বইয়ের দামও খুব বেশি নয়। বইয়ের দাম হয়তো আরো কমানো যেত, যদি বই কেনার আগ্রহ আরো বাড়ত। যদিও বইমেলায় দর্শনার্থীদের উপস্থিতির হার আশাব্যঞ্জক তবু তাঁরা কি সবাই বই কেনেন? এক্ষেত্রে সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে—‘বইয়ের দাম কমে না বলে আমরা বই কিনি না, আবার আমরা বই কিনি না বলে বইয়ের দাম কমে না।’
প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস্ ব্যবহারের আসক্তির কারণে সৃজনশীল বই পড়ার অভ্যাস ও আগ্রহ দুই-ই কমেছে। তবে অনলাইনে বই বা ই-বুক পড়ার প্রবণতা নাকি বাড়ছে। যদি তাই হয় তাহলে সেটাও ইতিবাচক; মানুষ বই তো পড়ছে! মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক হিসেবে আমি খুব কাছ থেকে কিশোর-তরুণদের দেখার সুযোগ পাই। সত্যি কথা বলতে তাদের বর্তমান যে জীবন যাপন তাতে সৃজনশীল বই তারা কিনবে বা পড়বে সেই সুযোগ খুব সীমিত। মূলত আগামী দিনের বইয়ের ক্রেতা ও পাঠক তো এখান থেকেই তৈরি হওয়ার কথা।
কথা হচ্ছে—আমাদের কিশোর-তরুণদের সৃজনশীল বই পড়ার আগ্রহ, অভ্যাস ও সুযোগ তৈরি করতে আমরা কী কী করেছি—যতটা করেছি মোবাইল, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস্ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে? আবার চলে আসে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। কিছুকাল আগেও দেখা যেত একজন আরেকজনকে বই উপহার দিচ্ছে এবং সেটা নির্দিষ্ট কোনো বয়সের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনো উপলক্ষে বই ছিল সেরা উপহার। কিন্তু এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে উপহারের জায়গায় চলে এসেছে মোবাইল ফোন, এমবি কার্ড, সিনেমার টিকেট, নগদ টাকা, আরো কত কী! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও উপহার দেওয়ার জায়গায় পরিবর্তন এসেছে। আগে যে কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হতো। এখন বইয়ের জায়গায় দেওয়া হচ্ছে প্লেট, বাটি, তোয়ালে, মগ ইত্যাদি। প্লেট, বাটি, তোয়ালে, মগ অবশ্যই প্রয়োজনীয় বস্তু, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন এগুলো উপহার দেবে?
আমি নিজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এই বিষয়ে একটু ধারণা দিতে পারি। যেমন প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানের আগে একটা কমিটি হয়, সেই কমিটি সার্বিক কাজ করার পাশাপাশি উপহারসামগ্রীও কিনে থাকেন। অনেকগুলো ইভেন্টে ‘ক্যাটাগরি’ অনুযায়ী উপহার কেনার কাজটা বেশ জটিল। আর যদি বইয়ের কথা চিন্তা করা হয় তাহলে বিষয়টা আরো জটিল। কেননা গ্রামে বা মফস্বলে প্রয়োজনমতো সৃজনশীল বই পাওয়া তো দূরের কথা, বইয়ের দোকানই খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সে তুলনায় মোবাইল ফোন, ফ্লেক্সি লোড, এমবি কার্ড বিক্রির দোকান হয়েছে প্রচুর। তো বইয়ের দোকান না পেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে সৃজনশীল বই তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বইয়ের দোকান হবেই বা কেন যদি বই বিক্রিই না হয়। আবার সেই কথাই চলে আসে—বইয়ের দোকান সহজলভ্য নয় বলে আমরা বই কিনি না, আবার আমরা বই কিনি না বলে বইয়ের দোকান সহজলভ্য হয় না।
প্রযুক্তিকে আমরা অনেকভাবেই কাজে লাগাচ্ছি। যার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থী ভর্তি ও নিবন্ধনসহ প্রায় সবকিছুই এখন অনলাইনে করা হয়। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কত সহজে সকল কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা করছে। তাহলে আমরা এই বই কেনার কাজটা কেন অনলাইনে করতে পারি না? বিষয়টা যত সহজে বলা গেল তত সহজে বাস্তবায়ন করা যাবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এটাও মনে রাখতে হবে শুরুতে অন্যসব বিষয় যেমন জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ মনে হয়েছে এবং পরে যেটা আমরা সহজেই ব্যবহার করতে পারছি, এটাও তেমন হবে। শুধু একটু উদ্যোগ লাগবে। আমরা সবাই যদি এই বিষয়ে একমত হই যে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে আমরা বই তুলে দেব তাহলে এটা সম্ভব। এবং নিশ্চিতভাবে এর সুফল ভোগ করবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।
নজরুল ইসলাম : লেখক ও এমফিল গবেষক, স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল : nazrul.russell@gmail.com
Leave a Reply