স্টাফ রিপোর্টারঃ চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় একই পরিবারের ৫ ভাইয়ের মধ্যে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। বর্তমানে শুধু ওই পরিবারটি নয়, উপজেলার প্রায় সব অধিবাসী আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ করুন বাস্তবতা তাড়া করছে এ জনপদের ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায়।
২১ বছর আগে দেশের সর্বোচ্চ আর্সেনিক কবল অঞ্চল হিসেবে এ উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সময় মতো নড়েচড়ে না বসায় আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে এবং বেড়েই চলছে। যার ফলশ্রুতিতে এ রোগের করাল গ্রাসে শাহরাস্তির এ পরিবারটিকে জীবনের বড় ধরনের মূল্যে দিতে হলো। অকালে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হলো পরিবারটির আপন তিন ভাই।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির ভাই হাবিবুর রহমান জানান, ইতিমধ্যে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তাদের পরিবারের ৫ সহোদরের ৩ জনই প্রাণ হারালেন। আর্সেনিকের কারণে আজ ৫ ভাইয়ের সংসার বেদনায় ভরা।
জীবিত দুই ভাইয়ের প্রাণও আজ ওষ্ঠাগত। পৌর শহরের ৭ নং ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ির মৃত মমতাজ উদ্দিনের পরিবারেরও একই অবস্থা।
১৯৭৬ সালে তাদের বাড়ির কাছে মসজিদের পাশে স্থাপিত একটি টিউবওয়েলের পানি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পান করে আসছিলো পরিবারটি। পরে ১৯৮৬ সালে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লে নিজ পরিবারের আঙিনায় একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে তার পানি পান করা শুরু করে।
পরিবারটির প্রথম (বড়) ভাই রহুল আমিন মানিক (৫৫) বি.কম. স্থানীয় শাহরাস্তি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৯১ সালে একটি এনজিওর মাধ্যমে প্রথম শনাক্ত হন তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত। ২০০৪ সালে ঢাকার আইসিডিডিআরবিতে তিনি পরীক্ষা করিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হন আর্সেনিক তাকে গ্রাস করেছে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ শুক্রবার তিনি আর্সেনিকের ছোবলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তৃতীয় ভাই মোঃ মজিবুর রহমান (৪৮) একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করতেন। তিনি জানতেন না, একইভাবে তাকেও আর্সেনিকের অক্টোপাস গিলে বসে আছে। যখন জনলেন তখন তো আর সময় নেই। এরই মধ্যে তার শরীরের গুরুত্ব পূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। ২০১৭ সালের অক্টোরের ১৯ তারিখ বৃহস্পতিবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় ভাই নুরুল আমিন (৫৫) বাড়ির পার্শ্বে তালতলা নামক স্থানে একটি চায়ের দোকান ছিল। তিনি দুই ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়া দেখে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে নড়েচড়ে বসেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, তিনিও আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। তখন তিনি ঢাকায় মহাখালীতে ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন, তার শরীরেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে। এরপর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে চা স্টলে দিন কাটাতেন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ মঙ্গলবার তার জীবনের প্রদীপটিও নিভে গিয়ে ভাইদের মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হন।
তাদের বেঁচে থাকা আর্সেনিকে আক্রান্ত ছোট ভাই হাবিবুর রহমান (৪৩) জানান, সবইতো হারালাম, এখন এ রোগের দহন নিয়ে আমার চতুর্থ ভাই মফিজুর রহমান (৪৫) আর আমি কোনমতে বেঁচে আছি। বর্তমানে ওই জনপদের শুধু এ পরিবার নয় ভুক্তভোগীরা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে কেউ জীবন, কেউ সংসার হারাচ্ছেন।
পার্শ্ববর্তী কচুয়া উপজেলার জনৈক গৃহবধূ নাহিদা (৩৩) ইউনিডোর এনজিওতে আর্সেনিক চিকিৎসা করিয়েও স্বামী ও সংসার টিকাতে পারেনি। বর্তমানে শাহরাস্তির আয়নাতলী গ্রামের গণমাধ্যম কর্মী হেলাল উদ্দিন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে দুটি কিডনি বিকল হওয়ার পথে। অনেকে আর্সেনিকযুক্ত পানি দীর্ঘ মেয়াদে পান করে, শরীরে নানান অসুখে বাসা বাঁধিয়ে চরম অসুস্থতা নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। এ ছাড়াও রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের শাহেদা বেগম ও তার স্বামী এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন।
শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এর ডাঃ অচিন্ত্য চক্রবর্ত্তী জানান, ২০১২ সালের পর থেকে সরকারি ভাবে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে না। আমরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছি। তারা বাইরে থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে। ২০১৭ ডিসেম্বরে ৫ হাজার ৬শ ৫৫ জন রোগীর শনাক্তকরণের হিসেব পাওয়া যায়। সর্বশেষ হিসাবে ২০১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো ১৪ জন রোগী শনাক্ত করা হয়।
শাহরাস্তি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস সিসিটি অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব আঃ হালিম জানান, ১৯৯৬ সালে প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত শাহরাস্তি উপজেলায় ১ হাজার ৭শত ৮৫ টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সচল রয়েছে ১ হাজার ৭শত ৪৫ টি এবং বিকল রয়েছে ৪০টি। চলতি অর্থ বছরে আরো ৬৫টি গভীর নলকূপ বসানোর টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন।
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র হাজী আঃ লতিফ জানান, ‘সম্প্রতি দেশের ৪০টি পৌরসভার সঙ্গে শাহরাস্তি পৌরসভায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করার লক্ষ্যে ও গ্রোথ সেন্টারে অবস্থিত পানি সরবরাহ ও এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় এ পৌরসভায় ভূপৃষ্ঠস্ত পানি শোধনাগার ও উচ্চ জলাধার নির্মান কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।’
এ জনপদে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান, অত্র উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের বিষাক্ত খুটির পর্যাপ্ত অপসারণ, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাক্তি পর্যায়ে শ্যালোমেশিন ও গভীর নলকূপ বসানোর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে সুপেয় খাবার পানির যোগানের একমাত্র ভূগর্ভস্থ উৎসটি হয়ে পড়ছে অনিরাপদ।
Leave a Reply