রোজাদার ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে। এতদসত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই কষ্টেকে সে অতি তুচ্ছ মনে করে। এ কারণে তাকে এমন পুরস্কারে ভূষিত করা হবে যা হবে তার ক্ষুৎপিপাসার যথার্থ বিনিময়। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, এ পানাহার বর্জন হতে হবে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে এবং তারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। যদি তার সিয়াম পালন সমাজ ও পরিবেশের চাপে পড়ে হয়, আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁর সন্তুষ্টির পরিবর্তে লোক-লজ্জা থেকে রেহাই পাওয়া বা ধার্মিকরূপে প্রশংসা কুড়ানোই যদি হয় তার সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য কিংবা নিছক স্বাস্থ্যগত উপকারের কথা ভেবেই যদি সে সিয়াম পালন করে, তবে সিয়ামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে সে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। সিয়ামের হিকমত ও তাৎপর্যের কোন ছাপ তার জীবনে প্রতিফলিত হবে না।
উপরন্তু সে বঞ্চিত হবে সিয়াম পালনকারীর জন্য নির্ধারিত মহাপুরস্কার থেকে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা:) সুস্পষ্ট ভাষায় উম্মাহকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, সিয়ামের উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কেননা এমন সিয়ামই শুধু আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য যার মূল উপাদান হচ্ছে ঈমান ও ইহ্তিসাব;
ইরশাদ হয়েছে: “যে ব্যক্তি ঈমানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রমজানের সিয়াম পালন করবে তার পূর্ব জীবনের সকল পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ আল বুখারী-১ খ-, হাদীস নং-১৯৩৫)
দ্বিতীয়তঃ সিয়ামের বাহ্যিকরূপ তথা বিধি-বিধানের প্রতি যেরূপ সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে তদ্রƒপ সিয়ামের হাকিকত ও মর্ম এবং সিয়ামের উদ্দেশ্য অনুধাবন ও তা সংরক্ষণের প্রতিও সযত্ন ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কাজেই একদিকে যেমন পানাহার বর্জন ও জৈবিক চাহিদা পরিহার করে চলতে হবে, তেমনি এমন সব অন্যায় ও অপরাধ সযতেœ পরিহার করতে হবে যা সিয়ামের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী, সিয়ামের লক্ষ ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থি এবং সিয়ামের নৈতিক ও চারিত্রিক সফলতা লাভের পথে অন্তরায়। সে দিকে ইঙ্গিত করেই নবীজী (সা:) ইরশাদ করেন “সিয়ামরত অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়। কেউ যদি তাকে অশালীন কথা বলে কিংবা তার সাথে অকারনে বাদানুবাদে লিপ্ত হতে চায় তবে সে যেন এ কথা বলে দেয় যে, আমি রোজাদার”। তিনি আরোও ইরশাদ করেন, “যে রোজা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম কিতাবুস সওম, হাদীস-১৯৩৭/১৯৩৮)
বস্তুত: যে সিয়াম তাকওয়া তথা খোদাভীতি ও হৃদয়ের পবিত্রতা শূন্য এবং চারিত্রিক মাহাত্ম ও চিন্তার বিশুদ্ধতা বঞ্চিত সে সিয়াম হচ্ছে প্রাণহীন এক দেহ যা শুধু স্বাস্থহীনতা ও দুর্গন্ধই ছড়ায়।
নবীজী (সা:) ইরশাদ করেন, “অনেক সিয়াম পালনকারী এমন যাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা সার হয়েছে। তদ্রƒপ অনেক ইবাদতকারী এমন যাদের বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই অর্জন হয় না। (সহীহ ইবনে হিব্বান: হাদীস-৩৫৬৩, সহীহ ইবনে খুযাইমা: হাদীস-১৮৮০, মুসতাদরাক : ১৫০২, মুসনাদে আহমদ: হাদীস-৯৪৭২)
বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তার বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ আল আলকানুল আরবায়া গন্থে লিখেছেন, “সিয়ামের সাধককে নিষেধাজ্ঞা পালনের সাথে সাথে ইতিবাচক বিষয়াবলীর প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করতে হবে। পানাহার ও জৈবিক চাহিদা বর্জন, গীবত ও পরনিন্দা পরিহার ঝগড়া বিবাদ ও যাবতীয় অশ্লীলতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে ইবাদত, তিলাওয়াত, যিকির ও তাসবিহ-তাহলীল এবং সালাত ও সালামে নিমগ্ন থেকে সমবেদনা সহানুভূতি সদয় আচরণ ও দানশীলতার মাধ্যমে সিয়ামের প্রভাবকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তবেই সিয়াম পালনকারী লাভ করবে ঘোষিত অফুরন্ত নেয়ামত ও মহা পুরস্কার। প্রশস্ত করে নিতে পারবে সে পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তির পথ। সফল হবে তার সিয়াম সাধনা।
আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ধর্মীয় শিক্ষক
চরকালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়