ধারণাটা আগেই করা হয়েছিল, দিলিস্নর মসনদে আবারও বসছেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি; যিনি নিজেকে জনগণের শাসক নয়- চৌকিদার হিসেবে পরিচয় দেন। শুক্রবার নাগাত নিশ্চিত হওয়া গেল ৩৫১টি আসনে জয়লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্ন্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ভোটগ্রহণ হয় ৫৪২টি আসনে। সেই হিসাবে কোনো দলকে সরকার গঠন করতে হলে পেতে হবে ২৭২টি আসন। শনিবার নিশ্চিত হওয়া গেল বিজেপি একাই পেয়েছে
৩০৩টি আসন।
নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে ভারতের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের; তারা পেয়েছে মাত্র ৫২টি আসন। ২০১৪ সালে এই দল পেয়েছিল ৪৪টি আসন। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম ও অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল, যার বর্তমান সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন দুই সহোদর- রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সকলেই জানেন, তারা হচ্ছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী এবং কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর সন্তান। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, নরেন্দ্র মোদির এ বিজয় আমাদের এই অঞ্চলে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য কোনো বার্তা কি না?
পরিবারতন্ত্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে খুব পরিচিত দৃশ্য। রাজনীতিতে দলের নেতা নির্বাচনে দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা, ত্যাগ ইত্যাদি বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ নেতা নির্বাচনে শুধুমাত্র দলীয় প্রধানের সন্তান, স্ত্রী বা সহোদরকে বিবেচনা করা হয়। অনেক সময় দলীয় প্রধানও তার পরিবারের সদস্যকে দলীয় কর্মকান্ডে বাড়তি সুযোগ প্রদান করে কর্মী ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করার পস্ন্যাটফর্ম তৈরি করে দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে আমাদের
এ অঞ্চলে বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সরকার প্রধান একটা বিশেষ পরিবার থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসছিল এবং জনগণও তাদের
গ্রহণ করেছে।
বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় এবং সেটা হয় পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বলয়েই। কলম্বোয় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত বক্তা ও রাজনীতিবিদ সলোমন বন্দরনায়েকে ছিলেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তৎকালীন সিলনের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫৯ সালে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কর্তৃক নিহত হওয়ার পর তার বিধবা পত্নী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি তিনবার সিলন ও শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার সময়েই সিলনের নাম বদলে শ্রীলংকা করা হয়। তার কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার মাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
মনোনীত করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপালা সিরিসেনার উত্থান হয় পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে থেকে। তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদানের পর ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিউ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তার প্রতিপক্ষ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মহিন্দ রাজাপক্ষকে পরাজিত করে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। তিনি নতুন ধারার রাজনীতির ঘোষণা দেন, যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রপতি একবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে
পারবেন না।
বর্তমানে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি প্রথম ২০০২ সালে সাধারণ নির্বাচনে একটি আসনে জয় পায়; ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটিকে বয়কট করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে দলটি ৭.৫ মিলিয়ন ভোট পায় এবং ৩৪টি আসনে জয়ী হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি ১৬.৯ মিলিয়ন ভোট পায় এবং ১১৬টি আসনে জয়ী হয়। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে থেকে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান খান। সেই নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি) পায়
মাত্র ৪৩টি আসন।
অথচ এক সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল পিপিপি। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো দলটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তাকে একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে দোষী সাব্যস্ত করে হত্যার পর কন্যা বেনজির ভুট্টো দলের সভাপতি হন এবং দুইবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে এক আত্মঘাতী হামলায় তিনি নিহত হলে তার ১৯ বয়সী পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে দলের সভাপতি মনোনীত করা হয়। যদিও বেনজির ভুট্টো তার উইলে সভাপতি পদের জন্য তার স্বামী আসিফ আলি জারদারিকে মনোনীত করেছিলেন কিন্তু জারদারি নিজেই ছেলের নাম প্রস্তাব করেন। পরবর্তী সময়ে পিপিপি ক্ষমতায় এলে জারদারি দেশের রাষ্ট্র্রপতি ও দলের সহ-সভাপতি হন।
সেই তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাব এখনও অনেক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই তাদের পূর্বপুরুষের (পিতা বা স্বামী) প্রতিনিধি হিসেবে সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে যারা বিরোধী দলের প্রধান ছিলেন, তারাও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বলয়ের বাইরে যেতে পারেননি। সম্প্রতি একজন সাবেক স্ব্বৈরশাসক, যিনি নয় বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তিনিও তার দলের উত্তরসূরি হিসেবে ছোট ভাইকে মনোনীত করেছেন। যদি তার কোনো সন্তান রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতেন তাহলে তিনি যে নিশ্চিতভাবে তার ভাইকে মনোনীত করতেন না, তা বলাই বাহুল্য!
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বলয়ে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক মেধা বলে অন্য যে কোনো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারলেও কেবল দলীয়প্রধান বা সরকারপ্রধান পদটিতে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না! রাজনীতি করতে হয় বিচক্ষণটা ও দূরদর্শিতা নিয়ে; নেতা নির্বাচন করতে হয় সাহস, প্রজ্ঞা, আনুগত্যতা এবং সবচেয়ে জরুরি ডিসিশন মেকিং ও ক্রাইসিস ম্যানেজিং সক্ষমতা দেখে। রক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে এই গুণাবলিগুলো মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়, এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। দলীয় প্রধানের সন্তান, স্ত্রী বা সহোদরকে লাইমলাইটে আনতে যে পরিমাণ সুযোগ দেয়া হয়, তা যদি দলের তৃণমূল থেকে উঠে আসা কোনো প্রতিভাবান নেতাকে দেয়া হয় তাহলে পরিবারতন্ত্রের বাইরে ক্যারিসমাটিক নেতা অবশ্যই তৈরি হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ভারত। ৯০ কোটি ভোটারের এই দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেই ভারতের রাজনীতিতে এক সময় কংগ্রেসের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মহাত্মা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীকালে তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মূলত ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরেই কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্রের শুরু। গান্ধী উপাধি ব্যবহার করলেও এই পরিবার মূলত নেহরু পরিবার। যারা ইতিহাস পড়েন তারা জানেন, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু কিভাবে ফিরোজ খান বিয়ে করলেন এবং ফিরোজ খান কীভাবে ফিরোজ গান্ধী হলেন।
পরিবারতন্ত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধীও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী ক্ষমতার কিনারে গিয়ে ফিরে এলেও দল ক্ষমতায় গেলে পুত্র রাহুল গান্ধী যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা একপ্রকার নিশ্চিত। সোনিয়া গান্ধী যখন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পুত্র রাহুল গান্ধী। সেই কংগ্রেস ২০০৯ সালের পর থেকে আর কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি। সর্বশেষ, ১৭তম লোকসভা নির্বাচনেও ভারতের জনগণ রায় দিলেন পরিবারতন্ত্রের বাইরে; গুজরাটের একজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে। এক সময়ের চা-বিক্রেতা নরেন্দ্র মোদির এ বিজয়কে সাধারণভাবে বিজেপির বিজয় বা কংগ্রেসের হার বলে মনে হলেও আমাদের ভাবতে হবে এই জনরায় পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিপক্ষে জনগণের কোনো বার্তা বহন করে কি না?
নজরুল ইসলাম : লেখক ও এমফিল গবেষক, স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
nazrul.russell@gmail.com