আইজ কাইল জীবনডারে জীবন মনে হয় না। কাঠের পুতুল মনে হয়। হ্যা আমিতো পুতুলই, হেই যে বারো বচ্ছরের কালে বিয়া কইরা আইনা নিজের ইচ্ছা মতো চালাইছে আমারে। মাইনষে হুনলে অভাক অইব, আজকের এই আধুনিক যুগে বারো বচ্ছরে বিয়া! হ আমিও অভাক হইছি, স্কুল থেইক্যা দৌড়াইয়া বাড়ি ফিরাই হুনছি আমার নাকি কাইল বিয়া! হের পর দিন একটা অচেনা বেটার লগে রাইত কাটাইলাম। গতর খানা বড়ো সড়ো হওয়ায় আর চামড়াডা সাদা হওয়ায় আমায় সবাই সুন্দরী কইয়া ডাকতো। এই দেইখ্যাইতো বিদেশী পোলায় বিয়া করলো আমারে। বিয়ার নয় বচ্ছরে পোলা মাইয়া হুদা দুইখান। নয় বচ্ছরে তো নয়ডা হওয়ার কতা! আমার স্বাদ আল্লাদের কোন দাম দিছে ? টাকার লইগা বিদেশে পইড়া আছে। আমার মনের একটা চাহিদা আছে, দেহের একটা……..( ছি ছি ছি… কি সব ভাবতাছি)।
মনে মনে বিরবির করছে ফাতেমা বানু। ফাতেমা নাম নিয়েও তার অভিযোগের শেষ নাই। নবী (সঃ) এর আদরের মেয়ের নাম ফাতেমা। ফাতেমা বানুর বাবাও হয়তো তাকে অনেক আদর করবে বলে তার জন্মের সময় ফাতেমা রেখেছিল। কিন্তু আদরের নমুনা আজ ফাতেমা বানু বুঝে। বড় মেয়ে রোকসানা। বড় মেয়ের নামটি রাখার পেছনে একটি কারণ আছে। কারণটি হলো এই নামের হতভাগা এক মেয়ে ছিল। তার বাবা নাকি তাকে নিজের হাতে মেরে কবর দিয়েছিল। ফাতেমা বানুর স্বামী সেলিম মিয়া বিদেশে থাকে, সে ও তো তার মেয়েকে আদর করে না। আদর যদি করতো তা হলে কি বিদেশ গিয়ে পড়ে থাকে বছরের পর বছর! তাই সে এই নামটি রেখেছে। ছোট ছেলে মনির হোসেনের বয়স ছয় মাস। এই নিয়ে-ই ফাতেমা বানুর সংসার। রাস্তার গা ঘেঁষে ফাতেমা বানুর বাড়ি। সারা দিনই গাড়ির শোঁ শোঁ-পোঁ পোঁ শব্দ। গাড়ির হর্ণের শব্দে মনির হোসেন আচম্কা চিৎকার করে উঠল। এতোক্ষন নিরিবিলি ঘুমাচ্ছিল সে।
মনিরের চিৎকার শুনে ফাতেমা বানু চেঁচিয়ে বলে উঠলঃ
হারামজাদা ড্রাইভার, হুইসাল দেওয়ার আর সময় পায়না। মাইনষে ঠিকই কয়, ড্রাইভারের জাতই খারাপ। বদজাত ড্রাইভার।
রাগে গো গো করছে ফাতেমা বানুর শরীর। দুদিন আগে ফাতেমা বানু রহিম খাঁর বাড়িতে গিয়ে ছিল। সলিম মিয়া তার জন্য দুটা সাবান, একটা তেলের বোতল আর কি কি পাঠিয়েছেন তা আনার জন্য। আসার সময় গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে এক যাত্রীর কথা কাঁটাকাঁটি হচ্ছিল। এক পর্যায়ে যাত্রী ড্রাইভারকে হারামজাদা বলে গালি দিলে ফাতেমা বানু প্রতিবাদ করে বলছিলঃ
আফনে ড্রাইভারকে গালাগালি করেন কেন! হেরা ড্রাইভার বইলা কি মানুষ না ? আফনে যদি এত ভালা হন তয় তারে গালি দেন কেমনে! কিন্তু আজ সে নিজেই ড্রাইভারকে গালি দিচ্ছে।
রোকসানাকে পেলে ফাতেমা বানু চুল ছিরে শাক রান্না করে খাবে। আজ স্কুলে যায়নি আবার মনিরকেও কোলে নেয়নি। সকাল থেকে বাড়িতেও নেই। মনিরকে কোলে নিলে ফাতেমা বানু সংসারের সব কাজ করতে পারে । মনিরের দাদি বেঁচে থাকলে এ চিন্তা ফাতেমা বানুর করতে হতো না। মাস খানেক হলো সে মারা গেছে। মনিরের দাদি মনিরকে খুব আদর করতো। সারা দিনই মনিরের সাথে নানা ধরনের কথা বলতো। কখনো কখনো আমার নাগর বলে হেসে উঠত।
এ অঞ্চলটা কৃষি প্রধান অঞ্চল। আর্থ সামাজিক দিক থেকে নি¤œ মধ্যবৃত্ত কৃষকদের জীবন-যাপন যেমনটা হয়। শিক্ষার হার বলতে বছরে দু-একজন ম্যাট্রিক পাশ আর বেশির ভাগ ৬ষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা কম। বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শহর মুখী রাস্তা পাঁচ ছয় গ্রাম ঘুরলে দু-তিন জন বিদেশী পাওয়া যাবে।
রোকসানা মা মা বলে দৌড়ে এসে ফাতেমা বানুর সামনে দাড়ালো।
মাগি পেডে ভরবি কি? এখানো রানতে বইতে পারি নাই। হারাদিন বাতার খুইজা কান্দি কান্দি দৌড়াইয়া বেড়াও! তোর ভাইডারে কে লইবো? চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো ফাতেমা বানু। রাগে ফুঁস ফুঁস শব্দ বের হচ্ছে ফাতেমা বানুর গলা থেকে। মায়ের রাগ দেখে স্থম্ভিত হয়ে গেল রোকসানা। তার চেহারায় কিছু বলার যে কৌতুহলী ভাবটা ছিল তা মুহূর্তেই কালো মেঘের আধাঁরে ছেয়ে গেল। অবস হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের কোল থেকে মনিরকে উঠানের এক কোনে মাচার উপড় গিয়ে বসল রোকসানা। জায়গাটা অনেক সুন্দর। ধূপছায়া ঘেরা, মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাঁপটা এসে পরে শরীরে। ফাতেমা বানুর বিরবির বন্ধ হলো না। আজ তার রাগের বলি হলো রোকসানা। রোকসানা মনিরের সাথে নানা রকমের খেলা আর কথা বলতে বলতে কিছুটা স্বস্তিতে ফিরে এলো। অপরাধবোধ কি তা এখনো সে ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনা। সাংসারিক কাজে মন দেয়াতে ফাতেমা বানুর রাগ কিছুটা কমলো। মায়ের রাগ কিছুটা কম দেখে রোকসানা মৃদু স্বরে বলল:
ওমা…. মা গো জমির গাজী আমাগো কী লাগে। তারে কি তুমি চেনো ?
কোন জমির কাজী ? রুঢ় কন্ঠে বলল ফাতেমা বানু।
ঐ যে নয়া ভিটির দিকে বাড়ি।
হ্যা, চিনি ক্যান কি অইছে ?
না হেয় আমারে জিগাইল তোমার বাপের নাম কি ? আমি কইলাম সলিম। হের পর হেয় কইল আমি তোমার কি হই জানো ? আমি কিছুু না ভাইবাই কইয়া ফালাইছি ভাই হোন। হের পর হেয় কইল হ আমি তোমার ভাই হই, তয় তুমি আমারে চাচা কইয়া ডাইকো। তোমার মায়তো দেখতে চমৎকার। হের পর হেয় কী হাসি হাসলো!
মাগো হেয় যদি আমাগো ভাই হয় তাহলে চাচা কইতে কইল ক্যান। আর এমন কইরা হাসলো ক্যান ? চুপ কর হারামজাদি, বাড়ি বাড়ি ঘুইরা এইসব হুইনা ঘরে ফিরোছ! সব কথা তোর জানতে হইব ক্যান ? ধমক দিল ফাতেমা বানু। রোকসানা আবার চুপসে গেল।
এই সব তিরস্কার আজ নতুন না। বিয়ের ২৫ দিন পর সেলিম মিয়া বিদেশে যাওয়ার পর হতেই শুনে আসছে ফাতেমা বানু। এসবে এখন আর কান নরে না তার। কিন্তু একটা ক্ষ্যাপা রাগ ঠিকই জন্ম নেয় তার ভেতর ভেতর। একদিকে নিজের ভেতরের যন্ত্রনা অন্য দিকে বাহিরের যন্ত্রনা, মাঝে মাঝে মনে হয় সব কিছু উজার করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার আল্লাদ উপভোগ করতে তার। আবার ভাবে সেলিম মিয়াতো তাদের সুখের কথা চিন্তা করে বিদেশে পড়ে আছে সংসার ছেড়ে। তার পাঠানো টাকা দিয়েইতো সংসার চলে, খেয়ে দেয়ে বেঁচে আছে তারা। সেলিম মিয়া তাকে অনেক বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসের গলায় ছুঁরি দিতে পারেনা ফাতমা বানু। তার পরও সে সেলিম মিয়াকে মনে মনে ঘৃনা করে। সেই দিন পাশের গ্রামের রহিম মিয়াজির বৌ কি কেলেঙ্কারি না করলো ২২ বছরের ছোকড়ার সাথে। সেই কথা মনে হলে ফাতেমা বানুর থুথু ফেলতে ইচ্ছে করে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল ফাতেমা বানু। এর পর ঝাড়–টা হাতে নিয়ে শপাং শপাং করে ঝাড়ু দিতে লাগলো উঠোনে। শরীরে সবটুকু ঘৃনা যেন ছেড়ে দিল উঠোনের উপড়।
Leave a Reply